Tuesday, April 5, 2016

Bogra Doi - বগুড়ার দই




 
বগুড়ার কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে অথবা অতিথি আপ্যায়নে খাবারের কথা উঠলেই সবার আগে নাম ওঠে দইয়ের। অতিথি আপ্যায়নে বগুড়ার দইয়ের বিকল্প নেই। যেমন স্বাদে অনন্য তেমনি মিষ্টি এই দই না খেলে এর গুণাগুণ জানাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ কারণেই বগুড়ায় যারা আসেন তারা দইয়ের স্বাদ না নিয়ে এ শহর ছাড়েন না। আর এই দইকে কেন্দ্র করে বগুড়া পেয়েছে নতুন পরিচিতি। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় দই এখন দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও চলে যাচ্ছে বিদেশে। বিদেশে বগুড়ার দইয়ের বিশাল বাজার তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর প্রসার হচ্ছে না। বগুড়ায় শতাধিক দোকানে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টাকার দই বেচাকেনা হয়। শুধু আনন্দ অনুষ্ঠানেই নয়, পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এই দইয়ের রয়েছে বাহারি নাম। প্রকারভেদে মিষ্টি দই, টক দই, সাদা (মিষ্টি ছাড়া) দই, ঘোল দই, বাটি দই, ডায়াবেটিস দই, স্পেশাল দই ইত্যাদি।

বগুড়াকে দইয়ের শহর বলা হয়। তবে শুরুটা হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকের দিকে গৌরগোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সরার দই তৈরি করেন। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারণা ছিল না। গৌরগোপালের এই দই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারে এ দই সরবরাহ করতেন গৌরগোপাল। ওই সময় এই দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। আজো নবাববাড়ীর পাশেই গৌরগোপালের ছেলে দিবাকর চন্দ্র পাল গৌরগোপাল দধিভাণ্ডারে বসে দই বিক্রি করছেন। তিনি জানান, প্রতিযোগিতার এই বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনোমতে তারা পৈতৃক ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন। বাজারে নিম্নমানের দইয়ের ভিড়ে বেশি দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি নিয়ে হয় ঝুট ঝামেলা।

স্বাধীনতার পর বগুড়ায় দই তৈরিতে শহরের গৌরগোপালের পাশাপাশি মহরম আলী ও বাঘোপাড়ার রফাত আলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ছোট ছোট মাটির পাত্রে (স্থানীয় ভাষায় হাঁড়ি) দই ভরানো হতো। ঘোষদের ছোট ছোট দোকান থাকলেও তখন ফেরি করেই দই বিক্রি হতো।

গৌরগোপাল ও মহরম আলীর পর বগুড়া দইঘরের মালিক আহসানুল কবির দই তৈরি ও বাজারজাতকরণে নতুনত্ব নিয়ে আসেন। তিনিই প্রথম ছোট ছোট পাতিলে দই ভরানো শুরু করেন। সেই সঙ্গে প্যাকেটিং ও দই সংরক্ষণেও আনেন নতুনত্ব। তিনি ৯০ এর দশকের শুরুর দিকে অতি মনোরম ও সুসজ্জিত শোরুমে দই বিক্রির প্রচলন করেন।

বগুড়া দইঘরের ম্যানেজার তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দই দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে তারা যে প্যাকেটে দই দেন তা শীতকালে থাকে চার-পাঁচ দিন। আর গরমকালে থাকে ২/৩ দিন। মানুষের হাতে হাতেই এই দই পেঁৗছে যায় বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে রপ্তানি করেন ইংলা্যান্ড, মালোয়েশিয়া, ভারত, কাতার, সৌদি আরবসহ যেসব দেশে বাংলাদেশিরা কর্মরত আছেন। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দই রপ্তানি হচ্ছে না।

বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের এশিয়া সুইটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হুদা তিলক জানান, তিন রকমের দই আমরা বিক্রি করে থাকি। এর মধ্যে স্পেশাল দই প্রতিটি ১৫০ টাকা, নরমাল ১৩০ টাকা, ডায়াবেটিস দই ১১০ টাকা। তিনি আরও জানান, স্পেশাল দইকে দুইভাবে বাজারজাত করা হয়। শাহী স্পেশাল এবং কড়া মিষ্টির স্পেশাল। দাম ১৫০ টাকা। এই দুটির মধ্যে শাহী স্পেশাল চিনির পরিমাণ কম এবং এর রং সাদা। বগুড়ায় প্রচুর বিক্রি হয় শাহী স্পেশাল এবং বগুড়ার বাইরের বিভিন্ন জেলার মানুষ বেশি কেনে কড়া মিষ্টির স্পেশাল দই।

বগুড়ার দই দেশের সীমারেখা ছেড়ে বিদেশেও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। গুণে, মানে, স্বাদে বগুড়ার দইয়ের তুলনা নেই। প্রবাসীরা বগুড়ার দই নিয়ে যান বিদেশে। বিদেশিরাও মুগ্ধ এ দইয়ের স্বাদে। বগুড়ার দই রপ্তানি হয় কানাডা, ফিলিপাইন, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বহু দেশে। সাধারণ প্যাকেটেই বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে এ দই পাঠানো হয় বিদেশে।

দই মিশে আছে বগুড়ার প্রাণে প্রাণে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই খেয়ে আবারও খাওয়ার আগ্রহ দেখাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি দই তৈরি হয়। তবে মানে আর গুণে বগুড়ার দই শীর্ষে। হোক তা অতি দরিদ্র কিংবা শহরের অতি বিলাসী পরিবার। অতিথি আপ্যায়নে বগুড়ার দইয়ের বিকল্প নেই। বগুড়ার দই তাই হয়ে উঠেছে আত্মীয়তার সেতুবন্ধন। বগুড়ার দই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় পাশের বেশ কয়েকটি জেলায়ও গড়ে উঠেছে দইয়ের রমরমা ব্যবসা।

Monday, June 11, 2012

Comillar Roshmalai - কুমিল্লার রসমালাই


Roshmalai
পাক-ভারত তথা উপমহাদেশে কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। আমাদের দেশে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যে কোনো অনুষ্ঠানেই মেনুর শেষ পর্বে থাকে কুমিল্লার রসমালাই। গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়নের তালিকায় কুমিল্লার রসমালাই আপন মহিমায় জায়গা করে নেয়।
রসমালাই-নাম শুনলেই জিভে জল আসে। সুস্বাদু এই মিষ্টান্নের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। রসমালাইয়ের নাম বলতেই সবার আগে মনে হয় কুমিল্লার নাম। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে রসমালাই তৈরি হলেও কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদের তুলনা নেই। দেশ-বিদেশের যে কোনো পর্যটক কুমিল্লায় বেড়াতে এসে রসমালাই না খেয়ে বা না কিনে কারও ফেরত যাওয়ার ঘটনা বিরল। কুমিল্লার রসমালাইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কুমিল্লা নামে ঐহিত্য। 

রসমালাই একদিকে যেমন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐহিত্যকে সমৃৃদ্ধ করেছে, তেমনি সুস্বাদু মিষ্টি হিসেবে বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। কুমিল্লার রসমালাই জেলাবাসীর সব উৎসব আয়োজনে যেমন কদর পায়, তেমনি কুমিল্লা থেকে কেউ বেড়াতে গেলেও রসমালাই নিয়ে যাওয়া বর্তমানে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। 

রসমালাই নামে উৎপত্তি

কুমিল্লা রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অর্ডার অনুযায়ী বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করত। সেই সময় রসগোল্লার সঙ্গে মালাইকারির প্রলেপ দেয়া এক প্রকার মিষ্টির প্রচলনও ছিল। কেউবা এটাকে মালাই রসগোল্লা বলত। পরবর্তী সময়ে দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে তার মধ্যে শুকনা রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় ক্ষীরসহ রসগোল্লা। এর নাম দেয়া হয় 'ক্ষীরভোগ'। রসমালাইর প্রথম নাম ক্ষীরভোগ। ত্রিশ দশকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের ক্ষীরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন করা শুরু হয় এবং এর নামকরণ হয়ে যায় রসমালাই।

 
যেখানে পাবেন উৎকৃষ্ট রসমলাই:
কুমিল্লা কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী ও কুমিল্লার বিভিন্ন মিষ্টি দোকানগুলোতে রসমলাই, অন্যান্য মিষ্টি ও দধি পাওয়া যায়। তবে উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু রসমলাই পেতে হলে আসতে হবে মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী দোকান।
কুমিল্লার রসমলাইয়ের দোকানের মধ্যে মাতৃভান্ডারের রয়েছে বাড়তি নাম। কুমিল্লার মনোহরপুরের আনাচে কানাচে রসমালাইয়ের এসব দোকানগুলোতে নেই কোন চাকচিক্য। বেশিরভাগ দোকানে বসার ব্যবস্থাও নেই। তবে ২/১ টি দোকানে বসে খাওয়ার জন্য আছে ৫/৬ টি আসন।
বাইরের চাকচিক্যের চেয়ে স্বাদ এবং মানই এসব দোকানিদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, দোকানগুলোর নাম, সুনাম ছড়িয়ে আছে। 

কুমিল্লার প্রসিদ্ধ রসমালাইয়ের দোকান
মাতৃভাণ্ডার ও ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার ছাড়াও কুমিল্লার আরও বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ রসমালাইয়ের দোকান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে শীতল ভাণ্ডার, জলযোগ, পোড়াবাড়ি, জেনিস, অমৃত মিষ্টি ভাণ্ডার, কুমিল্লা মিষ্টি ভাণ্ডার, মিষ্টিমেলা আরও অনেক। কুমিল্লার রসমালাইয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে অসংখ্য দোকান গড়ে উঠেছে। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে কুমিল্লার রসমালাই বলে। আসলে এগুলো খাঁটি নয়। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই বিক্রেতা মাতৃভাণ্ডার ও ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার তাদের ব্যবসার সুনাম রাখার জন্য কোথাও কোনো শাখা খুলেনি। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লা অংশে এখন অসংখ্য দোকানে বিক্রি হচ্ছে রসমালাই। এ দোকানগুলো মাতৃভাণ্ডার ও ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে ক্রেতাদের প্রতারিত করছে বারবার।


নকল শো-রুম :
অপরদিকে, ব্যাঙের ছাতার মতই যত্রতত্র গড়ে উঠছে নকল মাতৃভান্ডারসহ অন্য প্রসিদ্ধ রসমালাই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের শো-রুম। এতে প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা।  
কুমিল্লা জেলার রেল ষ্টেশন, গুরুত্বর্পূণ বাস স্ট্যান্ড, আলেখারচর বিশ্বরোড, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, হাইওয়ে রোডের বড় বড় হোটেলগুলোসহ ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ৯৭ কিঃমিঃ রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠছে এসব নকল শো-রুম।
ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম,কক্সবাজার, সিলেট, বি-বাড়িয়া প্রভৃতি জেলায়  ভ্রমণকারি লোকজন যাত্রাপথে গাড়ি থামার পর রসমলাই কিনে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে তারা প্রতারিত হচ্ছেন, আসল রসমলাইয়ের স্বাদ গ্রহণ থেকে। স্বাদের ভিন্নতা ছাড়াও তুলনামূলক ভাবে দামও বেশি রাখা হয়। আসল রসমলাই পেতে হলে মনোহরপুর, কান্দিরপাড় এর দোকান থেকে রসমলাই কিনতে হবে, তাহলেই প্রকৃত স্বাদ থেকে কেউ আর বঞ্চিত হবেনা।

স্পেশাল রসমালাই

জগৎ বিখ্যাত কুমিল্লার রসমালাইয়ের প্রথম তৈরি ও বিক্রি শুরু হয় শহরের মনোহরপুরে অবস্থিত 'মাতৃভাণ্ডারে'। ক্ষণী সেন ও মনি সেন নামের দুই ভাই কুমিল্লার মিষ্টি ব্যবসায় রসমালাই তৈরি করে আধুনিক ছোঁয়া নিয়ে আসেন। সেই থেকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডার আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এখনও মাতৃভাণ্ডারে প্রতিদিন ১ থেকে দেড় টন রসমালাই বিক্রি হয়। 
বর্তমানে কুমিল্লার কিছু কিছু দোকানে স্পেশাল রসমালাই নাম দিয়ে রসমালাইকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। এটি অন্য কিছু নয়। স্পেশাল রসমালাইয়ের মূল বৈশিষ্ট্য হলো দানা আকারের মিষ্টিগুলো অপেক্ষাকৃত একটু বড়।


ডায়াবেটিক রসমালাই

ডায়াবেটিক রোগীরা যাতে কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য কুমিল্লায় এখন ডায়াবেটিক রসমালাইও তৈরি হয়। ডায়াবেটিক রসমালাই প্রথম শুরু করেন শহরের নজরুল এভিনিউতে অবস্থিত অমৃত মিষ্টি ভাণ্ডার।


দরদাম: 
মাতৃভান্ডারে ১ কেজি রসমলাইয়ের দাম ১৭০ টাকা আর ১ প্লেট রসমলাইয়ের দাম ৩০ টাকা। অন্যান্য দোকানেও প্রায় একই দাম। রসমালাই বিক্রেতারা জানায়, শুধু মাতৃভান্ডারেই প্রতিদিন বিক্রি হয় প্রায় লাখ টাকার রসমলাই। তবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিক্রির পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় দেড় লাখে। বিক্রির দিক থেকে মাতৃভান্ডারের পরই ভগবতী মিষ্টি দোকান। এই দোকানেও প্রতিদিন ৭০-৮০ হাজার টাকার রসমলাই বিক্রি হয় ।
প্রতিদিন লাখ টাকার কেনাবেচা:
প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী, কান্দিরপাড়ের জলযোগ, জেনিস, পোড়াবাড়িতে দিন মজুর থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ভিড় জমায় রসমলাই কেনার জন্য। ক্রেতাদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিযোগিতা দেখা যায় গরম রসমলাই কার আগে কে কিনবে। ক্রেতাদের ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় দোকানের কর্মচারীদের। কেউ বাড়ির ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর জন্য, কেউবা মেহমানদের আপ্যায়ন করার জন্য, কেউবা আত্মীয়স্বজনদের জন্য, নতুন সর্ম্পক হচ্ছে এমন বাড়িতে নেয়ার জন্য এবং কেউবা অফিসের বসদের উপহার দেয়ার জন্য নিয়ে যান এই রসমালাই।

  যে পরিমাণ রসমালাই তৈরি হয় কুমিল্লায়:
কুমিল্লার রসমলাইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে মাতৃভান্ডারেই প্রতিদিন গড়ে ৫/৬ মণ রসমলাই তৈরি করা হয়। এই দোকানে প্রতিদিন ভোরে ও বিকেলে  ৫-৬ জন দুধ ব্যবসায়ি প্রায় ১০-১৫ মণ দুধ সরবরাহ করে থাকে। এদের প্রত্যেকে ৮০-১০০ কেজির উর্ধ্বে দুধ সরবরাহ করে থাকেন। মাতৃভান্ডারে দুধ দেয় শহরের কাশারীপট্রির দুধ ব্যবসায়ী ফয়সাল। সে জানায়, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অন্যদিনের তুলনায় ২০-৩০ কেজি দুধ বেশি দিতে হয়। এর কারণ এই দুই দিন অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি রসমলাই তৈরি করা হয়।
   ভিড় জমান বিদেশিরা:
গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়নের তালিকায় কুমিল্লার রসমালাই আপন মহিমায় জায়গা করে নেয়।
২০০৭ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত গীতা পার্সি বাংলাদেশ সফরে আসলে তার দুই সহযোগি কুমিল্লার মাতৃভান্ডারে এসে রসমলাই খেয়ে যাওয়ার সময় গীতা পার্সির ইচ্ছাতেই তার জন্য ২ কেজি রসমলাই ও দেড় কেজি ক্ষীর কিনে নিয়ে যান।
বাংলাদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকরাও বেড়াতে এসে কিনে নিয়ে যান কুমিল্লার রসমলাই ।

বিদেশে যাচ্ছে কুমিল্লার রসমলাইঃ
কুমিল্লার একাধিক সীমান্ত পথে অবৈধ ভাবে প্রতিদিন ২০/৩০ কেজি রসমলাই ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে বিক্রেতারা জানিয়েছেন। তারা জানায়, হিন্দুদের বড় পূজাগুলোতে বর্ডার কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই সুযোগে এসময় প্রতিদিন ৫/৬ মণ রসমলাই অবৈধ পথে ভারতে পাচার হয়। অবৈধ পথে যাওয়ার ফলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

রসমালাই তৈরি পদ্ধতি  বা প্রস্তুত প্রণালী:
রসগোল্লার রসমলাই খেতে বেশি স্বাদ। তবে চমচম হলেও বানানো যাবে। রসমালাই দুটি আলাদা মিষ্টান্নের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। রস মানে রসগোল্লা ও মালাইয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে রসমালাই পরিপূর্ণতা পায়। দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। প্রতি মণ দুধ দেড় ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে ১০-১২ কেজি মালাই তৈরি করা হয়। এ ঘনত্বের ওপরই রসমালাই স্বাদ এবং বিক্রির মূল্য তারতম্য দেখা দেয়। ঘন মালাই চুলা থেকে নামিয়ে আলাদা তৈরি করা ছোট ছোট দানার আকারে মিষ্টি বড় গামলায় মেশানো হয়। তারপর ঠাণ্ডা হলেই পূর্ণতা পায় রসমালাইয়ের। কুমিল্লার রসমালাইয়ের প্রবীণ কারিগর রতন চন্দ্র দে (৬০) বলেন, ভালোভাবে তৈরি রসমালাই ফ্রিজবিহীন ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখা হয়।

প্রথমেই মিষ্টিগুলো ছুড়ি দিয়ে কেটে ছোট ছোট পিস করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন ভেঙ্গে গুড়ো না হয়ে যায়। একটা বড় রসগোল্লা বা চমচম ৮/১০ টুকরো করতে হবে । ২ কেজি দুধ ভাল করে জাল দিয়ে প্রায় ১ কেজি পরিমাণ করে নিতে হবে। এবার এলাচ গুঁড়া , কনডেন্স মিল্ক ভাল করে মিলিয়ে নেড়ে দিতে হবে। চিনি মিলিয়ে নিতে হবে। কর্ণফ্লাওয়ার ভিন্ন পাত্রে গুলে নিন। এবার আস্তে আস্তে দুধে ঢেলে নাড়তে থাকুন ঘন না হওয়া পর্যন্ত। খেয়াল রাখুন দলা না পাকিয়ে ভালভাবে যেন মিশে যায়। এবার কেটে রাখা মিষ্টির পিসগুলো ভালভাবে মিশিয়ে কিছুক্ষণ পর নামিয়ে বলে ঢেলে দিন। কর্নফ্লাওয়ার দুধে মেলানোর কারণে মিষ্টির টুকরোগুলো ভাঙ্গবে না, রসমলাই ঘন হবে। মনে রাখবেন, রসমলাই তৈরি করতে দুধের পরিমাণ যেন কম না হয়। দুধ জাল দিয়ে ঘন করে নিয়ম অনুযায়ী উপকরণ গুলো মেলাবেন। এতে রসমলাই সুন্দর, সুস্বাদু এবং সুঘ্রাণযুক্ত হবে।

উপকরণ:
তাদের দেয়া রেসিপি অনুযায়ি, প্রতি কেজি রসমালাই তৈরির জন্য ২ কেজি দুধ, চিনি ২ কাপ, কনডেন্স মিল্কের এক কৌটার অর্ধেক, কর্নফ্লাওয়ার ১ চা চামচ, ২ চা চামচ গোলাপজল, এলাচ গুঁড়া আধা চা চামচ, রসগোল্লা বা চমচম বা যে কোন ধরনের মিষ্টি ‌আধা কেজি।