Tuesday, April 5, 2016

Bogra Doi - বগুড়ার দই




 
বগুড়ার কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে অথবা অতিথি আপ্যায়নে খাবারের কথা উঠলেই সবার আগে নাম ওঠে দইয়ের। অতিথি আপ্যায়নে বগুড়ার দইয়ের বিকল্প নেই। যেমন স্বাদে অনন্য তেমনি মিষ্টি এই দই না খেলে এর গুণাগুণ জানাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ কারণেই বগুড়ায় যারা আসেন তারা দইয়ের স্বাদ না নিয়ে এ শহর ছাড়েন না। আর এই দইকে কেন্দ্র করে বগুড়া পেয়েছে নতুন পরিচিতি। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় দই এখন দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও চলে যাচ্ছে বিদেশে। বিদেশে বগুড়ার দইয়ের বিশাল বাজার তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর প্রসার হচ্ছে না। বগুড়ায় শতাধিক দোকানে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টাকার দই বেচাকেনা হয়। শুধু আনন্দ অনুষ্ঠানেই নয়, পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এই দইয়ের রয়েছে বাহারি নাম। প্রকারভেদে মিষ্টি দই, টক দই, সাদা (মিষ্টি ছাড়া) দই, ঘোল দই, বাটি দই, ডায়াবেটিস দই, স্পেশাল দই ইত্যাদি।

বগুড়াকে দইয়ের শহর বলা হয়। তবে শুরুটা হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকের দিকে গৌরগোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সরার দই তৈরি করেন। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারণা ছিল না। গৌরগোপালের এই দই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারে এ দই সরবরাহ করতেন গৌরগোপাল। ওই সময় এই দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। আজো নবাববাড়ীর পাশেই গৌরগোপালের ছেলে দিবাকর চন্দ্র পাল গৌরগোপাল দধিভাণ্ডারে বসে দই বিক্রি করছেন। তিনি জানান, প্রতিযোগিতার এই বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনোমতে তারা পৈতৃক ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন। বাজারে নিম্নমানের দইয়ের ভিড়ে বেশি দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি নিয়ে হয় ঝুট ঝামেলা।

স্বাধীনতার পর বগুড়ায় দই তৈরিতে শহরের গৌরগোপালের পাশাপাশি মহরম আলী ও বাঘোপাড়ার রফাত আলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ছোট ছোট মাটির পাত্রে (স্থানীয় ভাষায় হাঁড়ি) দই ভরানো হতো। ঘোষদের ছোট ছোট দোকান থাকলেও তখন ফেরি করেই দই বিক্রি হতো।

গৌরগোপাল ও মহরম আলীর পর বগুড়া দইঘরের মালিক আহসানুল কবির দই তৈরি ও বাজারজাতকরণে নতুনত্ব নিয়ে আসেন। তিনিই প্রথম ছোট ছোট পাতিলে দই ভরানো শুরু করেন। সেই সঙ্গে প্যাকেটিং ও দই সংরক্ষণেও আনেন নতুনত্ব। তিনি ৯০ এর দশকের শুরুর দিকে অতি মনোরম ও সুসজ্জিত শোরুমে দই বিক্রির প্রচলন করেন।

বগুড়া দইঘরের ম্যানেজার তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দই দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে তারা যে প্যাকেটে দই দেন তা শীতকালে থাকে চার-পাঁচ দিন। আর গরমকালে থাকে ২/৩ দিন। মানুষের হাতে হাতেই এই দই পেঁৗছে যায় বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে রপ্তানি করেন ইংলা্যান্ড, মালোয়েশিয়া, ভারত, কাতার, সৌদি আরবসহ যেসব দেশে বাংলাদেশিরা কর্মরত আছেন। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দই রপ্তানি হচ্ছে না।

বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের এশিয়া সুইটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হুদা তিলক জানান, তিন রকমের দই আমরা বিক্রি করে থাকি। এর মধ্যে স্পেশাল দই প্রতিটি ১৫০ টাকা, নরমাল ১৩০ টাকা, ডায়াবেটিস দই ১১০ টাকা। তিনি আরও জানান, স্পেশাল দইকে দুইভাবে বাজারজাত করা হয়। শাহী স্পেশাল এবং কড়া মিষ্টির স্পেশাল। দাম ১৫০ টাকা। এই দুটির মধ্যে শাহী স্পেশাল চিনির পরিমাণ কম এবং এর রং সাদা। বগুড়ায় প্রচুর বিক্রি হয় শাহী স্পেশাল এবং বগুড়ার বাইরের বিভিন্ন জেলার মানুষ বেশি কেনে কড়া মিষ্টির স্পেশাল দই।

বগুড়ার দই দেশের সীমারেখা ছেড়ে বিদেশেও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। গুণে, মানে, স্বাদে বগুড়ার দইয়ের তুলনা নেই। প্রবাসীরা বগুড়ার দই নিয়ে যান বিদেশে। বিদেশিরাও মুগ্ধ এ দইয়ের স্বাদে। বগুড়ার দই রপ্তানি হয় কানাডা, ফিলিপাইন, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বহু দেশে। সাধারণ প্যাকেটেই বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে এ দই পাঠানো হয় বিদেশে।

দই মিশে আছে বগুড়ার প্রাণে প্রাণে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই খেয়ে আবারও খাওয়ার আগ্রহ দেখাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি দই তৈরি হয়। তবে মানে আর গুণে বগুড়ার দই শীর্ষে। হোক তা অতি দরিদ্র কিংবা শহরের অতি বিলাসী পরিবার। অতিথি আপ্যায়নে বগুড়ার দইয়ের বিকল্প নেই। বগুড়ার দই তাই হয়ে উঠেছে আত্মীয়তার সেতুবন্ধন। বগুড়ার দই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় পাশের বেশ কয়েকটি জেলায়ও গড়ে উঠেছে দইয়ের রমরমা ব্যবসা।